প্রোডাক্ট ম্যানেজমেন্ট ১০১

11 January 2024

ব্যবসা সে যে ধরনেরই হোক না কেন, এর সফলতার জন্য অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ইলিমেন্ট হলো প্রোডাক্ট ম্যানেজমেন্ট। প্রত্যেকটা কোম্পানিই চায় এমন প্রোডাক্ট তৈরি করতে যা কাস্টমারদের চাহিদা পূরণ করে ও কাস্টমারদের ভ্যালু প্রদান করে। সেজন্য প্রোডাক্টের একেবারে শুরু থেকে লঞ্চ করা পর্যন্ত সকল ধাপে নিতে হয় নির্ভুল সিদ্ধান্ত। এই কাজটি সম্ভব হয়ে থাকে প্রোডাক্ট ম্যানেজমেন্টের মাধ্যমে। 

আজকের এই ছোট্ট গাইডে আমরা প্রোডাক্ট ম্যানেজমেন্ট কী, এর গুরুত্ব, এতে কী কী কাজ করতে হয়, এতে কী কী টুলস প্রয়োজন হয় তা ব্যাখা করব। 

প্রোডাক্ট ম্যানেজমেন্ট কী? 

খুব সহজ করে বলতে গেলে প্রোডাক্ট ম্যানেজমেন্ট হলো একটি প্রোডাক্টের পুরো লাইফসাইকেলকে তদারক করা। কোনো প্রোডাক্টের আইডিয়া বিল্ডআপ করা থেকে শুরু করে এর প্ল্যানিং করা, ডেভেলপ করা, লঞ্চ করা, গ্রাহক পর্যন্ত পৌঁছে দেয়া এবং তারপরে গ্রাহকের মতামতের ভিত্তিতে প্রোডাক্টটি মেইনটেইন করা ইত্যাদি সকল কাজ প্রোডাক্ট ম্যানেজমেন্টের আওতায় পড়ে। প্রোডাক্ট ম্যানেজমেন্টের মূল উদ্দেশ্য হলো কাস্টমারের চাহিদা পূরণে বিজনেস স্ট্রাটেজির সাথে মিল রেখে একটি সফল প্রোডাক্ট উৎপাদন করা। 

এই কাজে নেতৃত্ব দিয়ে থাকেন প্রোডাক্ট ম্যানেজার। Ben Horowitz এর মতে একজন প্রোডাক্ট ম্যানেজার হলো একটি প্রোডাক্টের সিইও। একটি প্রোডাক্টকে মার্কেটের জন্য পার্ফেক্ট হিসেবে গড়ে তুলতে এর রিকোয়ারমেন্ট, ডিজাইন, ফিচার, ফাংশনালিটি, কাস্টমারদের সুবিধা-অসুবিধা, মার্কেট ট্রেন্ড ইত্যাদি অনেক কিছু নিয়ে ভাবতে হয়। এই সকল কাজ প্রোডাক্ট ম্যানেজার তত্ত্বাবধায়ন করেন। তার নির্দেশনায় সকল টিম মিলে কোলাবোরেট করে একসাথে কোনো একটি প্রোডাক্ট নিয়ে কাজ করে থাকে। 

প্রোডাক্ট ম্যানেজমেন্টের প্রয়োজনীয়তা কী? 

একটি বিজনেসের বেড়ে উঠা ও সফলতার পেছনে প্রোডাক্ট ম্যানেজমেন্ট বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। প্রোডাক্ট ম্যানেজমেন্টের মূল উদ্দেশ্যই হয় কাস্টমারদের দিক বিবেচনা করে ও বিজনেস গোল ঠিক রেখে বেস্ট প্রোডাক্টটি তৈরি করা। এর জন্য প্রোডাক্ট তৈরি করার প্রতিটি ধাপে ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নিতে হয়, আগে থেকেই স্ট্রাটেজি ঠিক করে নিতে হয়। 

সঠিকভাবে প্রোডাক্ট ম্যানেজ না করা গেলে হয়তো এমন প্রোডাক্ট তৈরি হতে পারে যা কাস্টমাররা পছন্দই করবে না কিংবা মার্কেটে কম্পিটিটরদের সাথে টিকতে পারবে না। প্রোডাক্ট তৈরিতে প্রতিটি বিজনেসকেই অনেক মূল্যবান রিসোর্স ও সময় ব্যয় করতে হয়। আবার প্রোডাক্ট বিক্রি করার মাধ্যমেই বিজনেস রেভিনিউ নিয়ে আসে। সেকারণেই প্রোডাক্টটি যদি মার্কেটে অচল হয়ে দাঁড়ায়, তা বিজনেসের জন্য অনেক বড় ক্ষতি ডেকে আনতে পারে। সোজা কথায় বলা যায় প্রোডাক্ট ম্যানেজমেন্ট হলো একটি বিজনেসের প্রাণশক্তি। 

একজন প্রোডাক্ট ম্যানেজার সাধারণত কী কী কাজ করে থাকেন? 

যেহেতু একটা প্রোডাক্টের সম্পূর্ণ লাইফসাইকেল জুড়েই প্রোডাক্ট ম্যানেজার নেতৃত্ব দিয়ে থাকেন, তাই তাকে বেশ অনেকগুলি দায়িত্ব পালন করতে হয়। প্রয়োজন অনুযায়ী একেকসময় তিনি একেকটি কাজে অংশ নেন। উনার প্রধান কিছু দায়িত্ব নিয়ে নিচে আলোচনা করা হলো:

১। প্রোডাক্টের রোডম্যাপ তৈরি করা: একটি প্রোডাক্টকে কীভাবে ডেভেলপ করা হবে, কী কী ফিচার এতে ইনক্লুড করা হবে এসব বিষয়ে সকল সিদ্ধান্ত প্রোডাক্ট ম্যানেজার নিয়ে থাকেন। প্রোডাক্টের এই সম্পূর্ণ রোডম্যাপ আগে থেকেই তাকে তৈরি করতে হয়। এর জন্য তাকে কাস্টমার ফিডব্যাক সংগ্রহ করতে হয় ও ক্রস-ফাংশনাল টিমের সাথে আলোচনা করে প্রোডাক্টের ভবিষ্যত ঠিক করতে হয়। 

২। কাস্টমারদের চাহিদা অ্যানালাইজ করা: একজন প্রোডাক্ট ম্যানেজার সবসময়ই কাস্টমারদের কী প্রয়োজন ও তারা কী চাচ্ছে সেটাকে গুরুত্ব দেন। কেননা সফল প্রোডাক্ট তৈরির জন্য Market requirement মেইনটেইন করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সেজন্য তিনি কাস্টমার সার্ভিসের সাথে একসাথে কাজ করেন, কাস্টমারদের ফিডব্যাক বিশ্লেষণ করে জানতে চেষ্টা করেন তার প্রোডাক্ট কোন কোন ক্ষেত্রে ভাল করছে কিংবা ব্যর্থ হচ্ছে। 

৩। টিমকে লিড দেয়া: প্রোডাক্ট ম্যানেজমেন্টের সাথে অনেকগুলি টিমই জড়িত থাকে। যেমন - ডিজাইনিং, ইঞ্জিনিয়ারিং, সেলস, মার্কেটিং ও কাস্টমার সার্ভিস টিম এই সকল টিম যেন সহজে নিজেদের মধ্যে কোলাবোরেশন করতে পারে সেজন্য তাদের মধ্যে যথাযথ কমিউনিকেশন ও নির্দেশনা প্রদানের কাজ প্রোডাক্ট ম্যানেজার করে থাকেন। 

৪। প্রোডাক্ট কোয়ালিটি ও ডেডলাইন মেইনটেইন করা: প্রোডাক্ট ম্যানেজমেন্টের একটি বড় উদ্দেশ্য হলো প্রোডাক্টের কোয়ালিটি বজায় রাখা। সেকারণে প্রোডাক্টের কোয়ালিটি বজায় রাখার কাজে তিনি নেতৃত্ব দেন। এছাড়া প্রোডাক্টে কতটুকু সময় ও পরিশ্রম দেয়া হবে সে ব্যাপারেও তিনিই সিদ্ধান্ত নেন এবং কাজগুলি সঠিকভাবে prioritize করে ডেডলাইন মেইনটেইন করাও তার দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। 

প্রোডাক্ট ম্যানেজমেন্টের ধাপগুলি কী কী? 

১। আইডিয়া নিয়ে ভাবা ও তা ম্যানেজ করা: একটি প্রোডাক্টের যাত্রা শুরুই একটি আইডিয়া ভাবার মাধ্যমে। নতুন কোনো প্রজেক্ট তৈরি করাই হোক কিংবা রানিং কোনো প্রজেক্টকে ইম্প্রুভ করা হোক, দুটো ক্ষেত্রেই কাজ শুরু হয় আইডিয়া জেনারেশন দিয়ে। আইডিয়া অনেকভাবেই পাওয়া যেতে পারে। কাস্টমারদের ফিডব্যাক অ্যানালাইসিস করে কিংবা নিজেদের মধ্যে ডিসকাশন করে। 

এভাবে পাওয়া বিভিন্ন আইডিয়া থেকে প্রোডাক্ট ম্যানেজার সিদ্ধান্ত নেন কোন কোন আইডিয়াগুলি ভাল এবং কোনগুলিকে অগ্রাধিকার দেয়া উচিত। 

২। প্রোডাক্ট স্পেসিফিকেশন ঠিক করা: প্রোডাক্ট স্পেসিফিকেশন এর মানে ধরে নিতে পারেন প্রোডাক্টের রেসিপি। একটি রান্নার রেসিপিতে যেমন কী কী উপাদান লাগবে তা লিস্ট করা থাকে, ঠিক তেমনি প্রোডাক্ট স্পেসিফিকেশন হলো একটি ডকুমেন্ট যেখানে প্রোডাক্টের সমস্ত ডিটেইল উল্লেখ করা থাকে। 

আগের ধাপে প্রোডাক্টের আইডিয়া ফাইনাল করে নেয়ার পর প্রোডাক্টটি নিয়ে ডিটেইলে এই স্পেফিফিকেশন লিখতে হয়। এই কাজটি সাধারণত প্রোডাক্ট ম্যানেজারই করে থাকেন। 

প্রোডাক্ট স্পেসিফিকেশন লিখার কাজটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কারণ এটি থেকেই প্রোডাক্ট ম্যানেজমেন্টের টিম প্রজেক্ট তৈরি সম্ভাব্য সময় ও এতে কী কী রিসোর্স ব্যবহার করতে হবে সে সম্পর্কে ধারণা পায়। 

৩। প্রোডাক্ট রোডম্যাপ তৈরি: এই ধাপে প্রোডাক্টটির স্পেসিফিকেশনকে বিবেচনায় রেখে একটি রোডম্যাপ তৈরি করা হয়। রোডম্যাপ হলো একটি প্রজেক্ট ম্যানেজমেন্ট স্ট্রাটেজির একটি ভিজুয়াল সামারি। অর্থাৎ এই রোডম্যাপ দেখেই সবাই বুঝতে পারবে প্রোডাক্ট ডেভেলপমেন্টের কোন পর্যায়ে কোন কাজটি করা হবে, ভবিষ্যতে এতে কী কী কাজ করা হবে এবং কখন করা হবে ইত্যাদি। 

৪। প্রায়োরিটাইজেশন (Prioritization): এই ধাপে এসে প্রোডাক্ট ম্যানেজার সব আইডিয়া ও টাস্কগুলি নিয়ে ভাবেন এবং ঠিক করেন কোন টাস্কগুলি নিয়ে আগে কাজ করা উচিত। এতে এটা নিশ্চিত হয় যেন প্রোডাক্ট ম্যানেজমেন্ট টিম আগে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জিনিসগুলি নিয়েই কাজ করে। 

৫। প্রোডাক্ট ডেভেলপ ও ডেলিভার করা: এত কিছু করার পর ফাইনালি এই ধাপে এসে প্রোডাক্টটি তৈরি করার কাজ শুরু হয়। এই ধাপে মূলত ডিজাইনার ও ডেভেলপাররা কাজ করে থাকেন এবং প্রোডাক্ট ম্যানেজমেন্ট টিমের তেমন কোনো কাজ থাকেনা। তবে তারা ডেভেলপারদের কাজ লক্ষ্য করেন, তাদের সাথে কোলাবোরেট করেন এটা নিশ্চিত করার জন্য যেন প্রোডাক্টটি ঠিকভাবেই ডেভেলপ করা হয়। প্রোডাক্টটি সম্পূর্ণ হয়ে গেলে তা টেস্ট করা হয় এবং ফাইনালি লঞ্চ করা হয়। 

৬। অ্যানালিটিকস এবং এক্সপেরিমেন্ট করা: যদিও বা প্রোডাক্ট তৈরির কাজ শেষ এবং প্রোডাক্ট কাস্টমারদের কাছে পৌঁছেও দেয়া হয়েছে, তবুও প্রোডাক্ট ম্যানেজারের কাজ শেষ হয় না। এই ধাপে এসে প্রজেক্ট ম্যানেজমেন্ট টিম বিভিন্ন তথ্য বিশ্লেষণ করে এবং প্রোডাক্টটি কতটুকু সফল হলো তা জানার চেষ্টা করে। কখনো কখনো এই ধাপে এক্সপেরিমেন্ট  হিসাবে প্রোডাক্টের সাথে নতুন ফিচার যুক্ত করে একটি ফিচার ভার্সনও রিলিজ করা হয়। 

৭। কাস্টমারদের কাছ থেকে ফিডব্যাক নেয়া: সর্বশেষ ধাপে কাস্টমারদের কাছ থেকে ফিডব্যাক নেয়া হয়। এই ধাপটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ কেননা কাস্টমারদের ফিডব্যাক থেকেই প্রজেক্ট ম্যানেজমেন্ট টিম জানতে পারে প্রকৃতপক্ষে কাস্টমাররা প্রোডাক্টটি পছন্দ করেছে কি না কিংবা কোন কোন ক্ষেত্রে প্রোডাক্টটি কাস্টমারের চাহিদা পূরণে ব্যর্থ হচ্ছে। এই সকল তথ্য পরবর্তীতে আরো ভালো প্রোডাক্ট তৈরি করতে সাহায্য করে। 

প্রোডাক্ট ম্যানেজমেন্টের কাজকে সহজ করার জন্য কোনো টুলস রয়েছে কি? থাকলে সেগুলি কী কী? 

আমরা একটু আগেই জেনেছি যে প্রোডাক্ট ম্যানেজমেন্টে ৭টি ধাপ রয়েছে। এমন অনেক টূলই রয়েছে যেগুলি এই প্রোডাক্ট ম্যানেজমেন্ট টিমকে বিভিন্ন ধাপে সাহায্য করতে পারে। এরকম কিছু টুলসের কথা নিচে বলা হলোঃ 

১। Clickup: এটি একটি প্রজেক্ট ম্যানেজমেন্ট টুল, প্রোডাক্ট ম্যানেজ করতে সাহায্য করে এমন অনেক ফিচারই এতে রয়েছে। 

২। Pivotal Tracker: এটি প্রজেক্ট প্ল্যানিং ও প্রজেক্ট ম্যানেজিং টূল যা দিয়ে Agile প্রোডাক্ট ম্যানেজমেন্ট করা যায়। 

৩। airfocus: এটি একটি প্রোডাক্ট ম্যানেজমেন্ট টুল যা দিয়ে স্ট্রাটেজি ম্যানেজ করা, prioritize করা, ও প্রোডাক্ট রোডম্যাপ তৈরি করা যায়। 

৪। Trello: এটি একটি প্রজেক্ট ম্যানেজমেন্ট টূল যা যেকোনো ধরনের প্রজেক্টের কাজে ও যেকোনো টিমের কাজেই ব্যবহার করা যাবে। এতে খুব সহজেই টিম কোলাবোরেশন করা যায়। 

৫। Jira: এটি একটি Agile প্রজেক্ট ম্যানেজমেন্ট টুল যা দিয়ে কোনো টিম প্রজেক্ট প্ল্যান করা, ট্র্যাক করা ও রিলিজ করা সম্পর্কিত যাবতীয় কাজ করতে পারে। 

৬। Slack: টিমের সাথে রিয়েলটাইম কমিউনিকেশন ও কোলাবোরেশনের জন্য ব্যবহার করা হয় 

৭। Figma: রিয়েল-টাইম কোলাবোরেট করে ডিজাইন করা, প্রোটোটাইপ তৈরি করা ও ইউজার টেস্টিং করার কাজে ব্যবহার করা হয়। 

৮। Google Analytics: এটি একটি ফ্রি Web Analytics সার্ভিস যা দিয়ে ওয়েবসাইট ও এপের বিভিন্ন স্ট্যাটিস্টিক্স পাওয়া যায় ও ইউজারদের আচরণ সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। 

৯। Balsamiq: Wireframe তৈরি করার কাজে ব্যবহার করা হয়। 

দিনশেষে প্রোডাক্ট ম্যানেজমেন্ট মানেই হলো স্মার্ট প্ল্যান করা, সব টিম একসাথে মিলে কাজ করা ও একটি চমৎকার কমিউনিকেশন বজায় রাখা। কাস্টমারদের চাহিদা পূরণ করতে পারে ও কম্পিটিটরদের টেক্কা দিতে পারে এমন প্রোডাক্ট তৈরির জন্য সঠিক প্রোডাক্ট ম্যানেজমেন্টের বিকল্প নেই। সফল বিজনেস প্রত্যেকে এই মন্ত্র দিয়েই ঠিক সময়ে ও বাজেটের মধ্যে নিজেদের প্রোডাক্ট লঞ্চ করতে পারছে। 

আশা করি এই পুরোটা লেখা ধৈর্য্য ধরে পড়ার পর এখন আপনিও প্রোডাক্ট ম্যানেজিং এর পুরো প্রসেস সম্পর্কে একটি ভাল ধারণা পেয়ে গেছেন। আপনার সাকসেসফুল প্রোডাক্ট ম্যানেজমেন্টের জন্য অগ্রীম অভিনন্দন জানাই!

Share this article

অনলাইন লাইভ স্কিল ডেভেলপমেন্ট প্ল্যাটফর্ম।

ডাউনলোড করুন ওস্তাদ অ্যাপ

কমিউনিটি -এর সাথে কানেক্টেড থাকতে